শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য স্বাধীন বিচার বিভাগ অপরিহার্য: প্রধান বিচারপতি
- Update Time : ০৩:০৯:০৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ অগাস্ট ২০২৩
- / ১ Time View
নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেছেন, শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচার বিভাগ অপরিহার্য।
এটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির বিদায়ী সংবর্ধনার জবাবে প্রধান বিচারপতি এ কথা বলেন। প্রধান বিচারপতির এজলাস কক্ষে এ সংবর্ধনা দেয়া হয়।
দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী অবসরে যাচ্ছেন আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর।
সে সময় সুপ্রিমকোর্ট অবকাশকালীন ছুটিতে থাকবে তাই আজই প্রধান বিচারপতির বিচারিক জীবনের শেষ কর্মদিবস। প্রথা অনুসারে আজ তাকে আপিল বিভাগের এক নম্বর বিচার কক্ষে এটর্নি জেনারেল অফিস ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি (সুপ্রিমকোর্ট বার) বিদায়ী সংবর্ধনা প্রদান করেন।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিগণ ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীরা যোগ দেন। অনুষ্ঠানে এটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন ও সুপ্রিমকোর্ট বার সভাপতি মোমতাজউদ্দিন ফকির প্রধান বিচারপতির কর্মময় জীবনের নানা দিক তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন।
বিদায়ী সংবর্ধনায় দেয়া বক্তৃতায় প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচার বিভাগ প্রজাতন্ত্রের হৃৎপিণ্ড। রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের দক্ষতার চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের আর কোন উপযুক্ত পরীক্ষা নেই। একটি জাতির জনগণ শাসন বিভাগ বা আইন বিভাগের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারে, কিন্তু বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা হারালে সে জাতিকে খারাপ দিনটির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
তিনি বলেন, সাংবিধানিক বিধান দিয়ে সর্বপ্রকার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বিচার বিভাগকে মজবুত দেওয়াল দিয়ে রক্ষা করার দায়িত্ব বিচারকদের, আইনজীবীদের এবং রাষ্ট্রের প্রত্যেক দায়িত্বশীল নাগরিকের। সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে সর্বনাশা দিনের জন্য প্রতিটি নাগরিকের অপেক্ষা করতে হবে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, রাজনৈতিক বিভক্তি রাজপথ অতিক্রম করে বিচারালয় অভিমুখে ধাবিত হলে সেটা বিচারলয়ের জন্য মঙ্গলজনক হয় না। আমাদের মনে রাখতে হবে, আইনজীবীদের বিভক্তি ও মতভেদ এবং তার প্রতিক্রিয়া বিচারালয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রাজনৈতিক মতাদর্শ রাজনৈতিকভাবে বাস্তবায়ন করলে এবং বিচারলয়কে নিরাপদ দূরত্বে রাখলে বিচার বিভাগ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আমার মনে হয় আমার উত্তরাধিকারী গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবেন এবং আমি এটাও মনে করি মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার অধিকারী করবেন এবং বিচার বিভাগকে আরও গতিশীল বিচার বিভাগে পরিণত করবেন।
তিনি বলেন, আইনের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বা প্রাধান্য কার্যকর করার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। বিচার বিভাগ যদি আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ বা পিছপা হয় তাহলে রাষ্ট্র এবং নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। বিচার বিভাগ সংবিধানের আধিপত্য রক্ষার পাশাপাশি জনগণের মৌলিক অধিকারের রক্ষক।
তিনি বলেন, সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের বিকাশ, আইনের শাসন সংরক্ষণ এবং সমাজের দুর্বল অংশের অধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য। সুপ্রিমকোর্ট বিচার প্রশাসনের সর্বোচ্চ আদালত আর বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সর্বোচ্চত্বের উপর নির্ভর করে। যে মহান চিন্তা ও কল্যাণ চেতনাকে সন্নিবেশিত করে আমাদের সংবিধান প্রণীত হয়েছে, তার ধারক ও বাহক হিসেবে, দেশের সকল আইন ও সকল আইনগত কার্যক্রম সাংবিধানিক চেতনার প্রতিফলন নিশ্চিত করার সুমহান জাতীয় দায়িত্ব আমাদের সবার। মানুষ চায় শান্তি আর শান্তি, কিন্তু পরিপূর্ণ শান্তির জন্য আমাদের এখনও অনেকটাই এগুতে হবে। আমাদের আঁকা-বাঁকা জায়গাগুলোকে সোজা করতে হবে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, সংবিধান প্রণেতারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন-সে স্বাধীনতা কার্যকর করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গের এবং প্রতিটি নাগরিকের। সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ৭১’ এর রক্ত বৃথা যাবে। মনে রাখতে হবে, জনগণের ঐক্যবদ্ধ বীরত্ব এবং সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই দেশ, এই বিচারালয় পেয়েছি। ৭১’এ জাতি চরম ত্যাগ স্বীকার করে স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছে। আমাদের জাতীয় দায়িত্ব হলো সর্বক্ষেত্রে সেই দেশকে এগিয়ে নেয়া। আমরা ব্যর্থ হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। আমাদের প্রতিটি আইনে মানবিকতার স্পর্শ থাকতে হবে। আইন যদি দরিদ্রকে পিষে দেয় আর ধনী ব্যক্তি যদি আইনকে পিষে দেয় তাহলে রাষ্ট্র এবং বিচার বিভাগ সঠিকভাবে চলছে-এটা কোনভাবেই বলা যাবে না।
প্রধান বিচারপতি বলেন, শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচার বিভাগ অপরিহার্য। গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা আর বিচারকদের রাজনৈতিকভাবে বয়ে যাওয়া হাওয়া থেকে নিজেদের মুক্ত রেখে, সংবিধান, আইন নিজেদের বিচারিক বিবেকের প্রতি পরিপূর্ণ অনুগত থেকে বিচার কার্য সমাধান করা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় জনগণের অগাধ আস্থা স্থাপন করতে হবে এবং থাকতে হবে, নইলে দেশের জনগণের অধিকার রক্ষা হবে না এবং স্বাধীনতাও বিপন্ন হবে। সব বিচারককে অসামান্য নৈতিকতার অধিকারী হতে হবে, নইলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা শুধুমাত্র সংবিধানের ভেতরই আবদ্ধ থাকবে। ধন্য তারাই, যারা অন্তরে শুদ্ধ।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আমাদের সংবিধান ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে রঞ্জিত এবং প্রত্যেক দেশবাসীর উপর পবিত্রভাবে বাধ্যতামূলক- যেখানে রাষ্ট্রে বিভিন্ন অঙ্গের এখতিয়ার এবং ক্ষমতা, সঠিক আইন প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের পবিত্র দায়িত্ব হলো এর প্রতিটি অক্ষরের প্রতি অনুগত থাকা এবং সঠিক ব্যাখ্যা দেয়া সবার ভেতর এমন একটা ভিত তৈরি করতে হবে যেন প্রতিটি নাগরিক আমাদের এই দেশটাকে প্রচণ্ডরকম ভালোবাসে এবং ৭১’ এর রক্তকে মূল্য দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে এবং অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করতে সততার সাথে কঠোর পরিশ্রম করে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, জুডিশিয়ারিকে পরিবর্তন করার জন্য জনসাধারণের চাহিদা এবং তাদের ক্রমবর্ধমান অনুভূতি এবং সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টার আকাঙ্ক্ষা কাজ করেছে আমার নিজের ভেতর। হয়তো আমি নাড়া দিতে পেরেছি মাত্র। আমার পদক্ষেপগুলো তাদের সমাধানের পথের নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে, কিন্তু সম্পূর্ণ সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয়। এজন্য দরকার নিয়ামক শক্তিগুলোর একই মন-মানসিকতা এবং সমন্বিত উদ্যোগ এবং প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান আর সমাজব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এবং পদক্ষেপ। আমি সবসময় মনে করেছি আমি বাংলার, বাংলা আমার এবং আমি মুসলিম, আমি বাঙালি আর ৭১’ আমার প্রেরণা। আমি চেষ্টা করেছি জনগণের ইচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষাকে আমার কাজের মধ্যে প্রতিফলন ঘটাতে। জুডিশিয়ারিকে সুশৃঙ্খল এবং গতিশীল করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। আমাদের বিচার বিভাগ পৃথিবীতে শক্তিশালী বিচার বিভাগগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশকে বসবাসের জন্য আরও ভালো জায়গা করার লক্ষ্যে জনগণ যাতে স্বল্প খরচে স্বল্প সময়ে ন্যায়বিচার পায়, তার জন্য আমার বিচারকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করেছি বিচারপ্রার্থী অভাগা মানুষগুলো আদালত প্রাঙ্গনে এসে একটু স্বস্তিতে বসতে পারে তার ব্যবস্থা করতে। বিচারকদের বুঝাতে চেষ্টা করেছি সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা মানুষের বিচারিক সেবা দেবার জন্যই বিচারকের দায়িত্ব দিয়েছেন। রাষ্ট্রে আর্থিক সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও ন্যায়কুঞ্জের জন্য, রেকর্ড ভবনের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আমার চমৎকার শেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। শিখেছি আইনজীবীদের আলোচনা, যুক্তি, আইনি ব্যাখ্যা, ঘটনার বিশ্লেষণ করার কৌশল থেকে। চেষ্টা করেছি আপনাদের শুনে-বুঝে, বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দেওয়ার। আমি প্রতিটি স্তরে বারের কাছে ঋণী। বার হলো বিচারকদের বিচারক। আমি সবসময় তেমনটিই ভেবেছি। আমি চেষ্টা করেছি ধৈর্য্য সহকারে শোনার, যত্ন সহকারে বিবেচনা করার, সঠিকভাবে বোঝার এবং ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত দেয়ার। একজন রাজনীতিবিদ পরবর্তী নির্বাচনের কথা ভাবেন, একজন রাষ্ট্রনায়ক পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভাবেন আর একজন বিচারককে ভাবতে হবে সংবিধান ও আইনানুযায়ী ন্যায়বিচার করার কথা। তিনি বলেন, আমি জুনিয়র আইনজীবীদের বলবো, তোমরা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মতো পরিশ্রমী ও শক্তিশালী হও কিন্তু ভদ্রতাকে বিসর্জন দিয়ে নয়, দয়ালু হও কিন্তু দুর্বল নয়, সাহসী হও কিন্তু আদালতকে ধমকাবে না, চিন্তাশীল হও কিন্তু অলস হয়ো না, নম্র হও কিন্তু ভীরু হয়ো না, গর্বিত হও কিন্তু অহংকারী নয়, হাস্যরসিক হও কিন্তু মূর্খতা ছাড়া। সৎ থাকো, পরিশ্রম করো, একদিন দেখবে অনেক বড় আইনজীবী হয়ে গিয়েছো। মহাকাশের মতো উদার হও যেখানে কোন জাতীয় সংঘাত নেই।
প্রধান বিচারপতি বলেন, এখানে আমার ৪৩ বছরের পদচারণা আজ থেকে স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মহাশক্তিতে বিশ্বাস করি, তিনি এই পবিত্র বিচারালয়, বিচারকগণ, আইনজীবীগণ, বিচারালয়ের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের রক্ষা ও সঠিক পথে চলার তওফিক দান করবেন। আমার কর্মকালীন সময়ে বিচারকবৃন্দ, আইনজীবীবৃন্দ, আইন, বিচার এবং সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, অর্থ, জনপ্রশাসন, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সহ এবং সুপ্রীম কোর্ট রেজিষ্ট্রির প্রত্যেক কর্মকর্তা এবং কর্মচারী এবং সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা যে সহায়তা দিয়েছেন, তা আমি কৃতজ্ঞতার সাথে সারাজীবন মনে রাখবো।
বক্তব্যের এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, এই বিদায়মুহূর্তে আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি আমার মরহুম বাবা-মাকে। আমার জন্য এবং আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য অপরিসীম কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করে তারা জান্নাতবাসী হয়েছেন। তারা আমার সংগ্রামের পথে সহায়তা করেছেন। এ কথা বলেই প্রধান বিচারপতি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন, কেঁদে ওঠেন। এক মিনিটের মতোও কথা বলতে পারেননি তিনি। এ সময় এজলাস কক্ষে উপস্থিত থাকা প্রধান বিচারপতির বড় মেয়ে, নাতি ও ছোট মেয়ের জামাইকেও কাঁদতে দেখা যায়। কিছু সময়ের জন্য এজলাস কক্ষের পুরো পরিবেশ নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। এরপর প্রধান বিচারপতি আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, আমি বিচার বিভাগকে বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম এবং আমি চেষ্টা করেছি স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে।
ডিএএম/কেকে//