সারাদেশ ডেস্ক :
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেয়াপোলিসের রাস্তায় গত বছর আফ্রিকান-আমেরিকান নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনায় সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক শভিনকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছে মার্কিন আদালত।
এক ভিডিওতে দেখা যায়, গত বছর মে মাসে মি. ফ্লয়েডকে গ্রেফতারের সময় তার গলার উপর ৯ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে হাঁটু গেড়ে বসে ছিলেন ৪৫ বছর বয়সী পুলিশ অফিসার ডেরেক শভিন। এই ঘটনায় বিশ্বজুড়ে পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
শভিনকে তিনটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়: ১. সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডার ২. থার্ড ডিগ্রি মার্ডার এবং ৩. নরহত্যা।
শাস্তি ঘোষণা না করা পর্যন্ত তিনি পুলিশি হেফাজতে থাকবেন। সাজা হিসেবে কয়েক দশক জেল খাটতে হতে পারে তাকে।
এই রায়ে পৌঁছাতে জুরিকেদের পুরো একদিন সময় নেন। এর আগে তিন সপ্তাহ ধরে বিচার কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়।
ফ্লয়েড পরিবারের আইনজীবী বেন ক্রাম্প বলেন, এই রায় যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার মতো একটি ঘটনা।
এক টুইটে তিনি বলেন, “কষ্ট দিয়ে অর্জিত ন্যায়বিচার অবশেষে হাতে এলো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও যে জবাবদিহিতা থাকা দরকার সেটিই এই রায়ের মাধ্যমে পাওয়া গেলো।”
রায় ঘোষণার পর পরই ফ্লয়েড পরিবারকে টেলিফোন করেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস। বাইডেনকে বলতে শোনা যায়, অবশেষে ন্যায়বিচার হলো। আমাদের আরো অনেক কিছু করতে হবে। পদ্ধতিগত বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এটি ছিল প্রথম পদক্ষেপ। প্রেসিডেন্ট বলেন। টেলিভিশনে দেয়া জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বাইডেন বলেন: “পদ্ধতিগত বর্ণবাদ পুরো জাতীয় আত্মার উপর একটি কলঙ্ক।”
জর্জ ফ্লয়েডের কী হয়েছিল?
২০২০ সালের ২৫শে মে মিনেয়াপোলিসের একটি দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনেছিলেন ৪৬ বছর বয়সী জর্জ ফ্লয়েড।
দোকানের এক সহায়তাকর্মী মনে করেছিলেন যে, তিনি ২০ ডলার মূল্যের একটি নকল বিল ব্যবহার করছিলেন এবং মি. ফ্লয়েড যখন সিগারেটের প্যাকেটটি ফেরত দিতে চাননি তখন তিনি পুলিশ ডাকেন।
পুলিশ পৌঁছানোর পর তারা মি. ফ্লয়েডকে তার পার্ক করে রাখা গাড়ি থেকে নামতে বলেন এবং তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেয়া হয়। পুলিশের গাড়িতে তোলার সময় মি. ফ্লয়েড চিৎকার করার চেষ্টা করলে ধ্বস্তাধস্তি হয়। তারা তাকে জোর করে মাটিতে ফেলে দেহের ওজন দিয়ে চেপে ধরেন।
শভিন তার হাঁটু মি. ফ্লয়েডের পিছনের ঘাড়ের উপর ৯ মিনিট ধরে চেপে ধরে বসে থাকে। এসময় ফ্লয়েড অন্তত কুড়িবার বলেছিলেন যে, তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না। ফ্লয়েড বলছিলেন, “দয়া করুন, দয়া করুন, দয়া করুন”।
যখন অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছায় ততক্ষণে মি. ফ্লয়েড নিথর হয়ে গেছেন। এর এক ঘণ্টা পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। পুলিশকে বার বারই মি. ফ্লয়েড জানান যে তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না।
বিচার: শভিনের বিচারের সময় বিচারকেরা ৪৫ জন প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দী শোনেন এবং কয়েক ঘণ্টা ধরে ভিডিও ফুটেজ দেখেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে অনেকেই ঘটনাটির নিখুঁত বর্ণনা দেন। অনেকেই ভিডিও ফুটেজটি দেখার সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং সেসময় তারা “অসহায়” বোধ করার কথা জানান।
মি. ফ্লয়েডের প্রেমিকা কোর্টনি রস এবং তার ছোট ভাই ফিলোনিস ফ্লয়েড মিলে মৃত মি. ফ্লয়েডের অতীত জীবন বর্ণনা করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, মি. ফ্লয়েড অক্সিজেন না পেয়েই মারা গেছেন এবং এটা হয়েছে শভিন ও তার সহকর্মীদের কারণে।
শুনানিতে কোন বক্তব্য না দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মি. শভিন।
অভিযোগ: নরহত্যা হচ্ছে যখন কেউ অনিচ্ছাকৃতভাবে অন্য আরেক ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ হয়। সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডার হচ্ছে, হত্যাকাণ্ডটি ইচ্ছেকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃত ছিল। এই অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা ৪০ বছর। থার্ড ডিগ্রি মার্ডার মানে হচ্ছে, কোন ব্যক্তি এমন কোন কাজ করেছে যার কারণে অন্য এক বা একাধিক ব্যক্তির প্রাণনাশ হয়েছে।
পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ কর্মকর্তাদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ঘটনা বিরল। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের ঘটনাও কম। তবে ভবিষ্যতে এ ধরণের ঘটনার ক্ষেত্রে মার্কিন বিচার ব্যবস্থা কিভাবে নেবে তার একটি উদাহরণ হিসেবে এই রায়কে দেখা হচ্ছে।
জুরিরা কিভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন?
শভিন কারাগারে যাবেন নাকি তাকে মুক্তি দেয়া হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ১২ জন জুরিকে দায়িত্ব দেয়া হয়। কোন জুরিরই পরিচয় প্রকাশ হয়নি এবং পুরো বিচার প্রক্রিয়ায় তারা কেউ সামনেও আসেননি, তবে বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বলতে গেলে এদের মধ্যে তরুণ, শ্বেতাঙ্গের আধিক্য এবং নারী বিচারক বেশি ছিলেন।ম
সোমবার দুপক্ষই যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শেষ করার পর, জুরিরা একটি হোটেলে অন্য সবার থেকে আলাদা হয়ে একটি রায় প্রদান করেন।
বিচারকেরা সবাই সর্বসম্মতভাবে এই রায়ে পৌঁছান এবং এর আগ পর্যন্ত তারা কেউ ঘরে ফিরতে পারবেন না বলেও জানানো হয়।
এ রায় বিশ্বব্যাপী প্রশংসীত হচ্ছে। আইনজ্ঞরা বলেন ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’- এটি রায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেউ আইনের. উর্ধ্বে নন এবং জবাবদিহিতার বিষয়টি এ রায়ে নিশ্চিত হয়েছে যা বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্ত হবে।
ডিএএম//
Leave a Reply