বিশেষ প্রতিবেদক: বাংলার জাতীয় জীবনে ২৫ মার্চ ফিরিয়ে আনে এক বিভীষিকাময় ভয়াবহ করুণ স্মৃতি। ১৯৭১ সালের সেই ভয়াল ২৫ মার্চ এ জাতি কখনো ভূলবেনা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে ভয়ঙ্কর সেই রাতের কথা স্মরণ করছে জাতি।
১৯৭১ সালের সেই রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র, নিরপরাধ ও ঘুমন্ত সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়, যা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচাইতে ঘৃণ্য গণহত্যার নজির। ঘুমন্ত মানুষের ওপর নির্বিচার হামলা ও গনহত্যার এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে নেই।
আজ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের মানুষ বর্বর হত্যাযজ্ঞের সেই দিনটিকে স্মরণ করছে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে। ২৩ বছরের শোষণ থেকে বাঙালির মুক্তির আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সেই অভিযানে কালরাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় চালানো হয় গণহত্যা।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দেন- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে বাংলার নেতৃত্বের সঙ্গে ১৬ মার্চ থেকে আলোচনার নাটকের পর ২৫ তারিখ সন্ধ্যায় হত্যাযজ্ঞ চালানোর নির্দেশ দিয়ে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে বিমানে ওঠেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। ইয়াহিয়া নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে নামতেই পূর্ব পাকিস্তানে তৎপর হয়ে ওঠে তার বাহিনী। মধ্যরাতে ঢাকায় শুরু হয় তাদের নিধনযজ্ঞ। ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা, পুলিশ-ইপিআর ব্যারাকসহ আবাসিক এলাকা এবং বস্তিবাসীর ওপর নজিরবিহীন আক্রমণ চালায়। নয় মাসব্যাপী ভয়াবহ গণহত্যা, নিপীড়ন, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজের সূচনা হয় এ রাতে। রাত ১টার পর ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে পাকিস্তানি সেনারা ট্যাংক আর সাঁজোয়া যান নিয়ে গিয়ে গ্রেফতার করে স্বাধীনতাকামী বাংলার আন্দোলন-লড়াই-সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। পরে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।
গণহত্যা দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, “অপারেশন সার্চলাই” নামে অভিযানটি পরিচালনার মাধ্যমে তারা স্বাধীনতাকামী ছাত্রজনতার প্রতিরোধকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। এর ব্যাপ্তি ছিল ঢাকাসহ সারাদেশ।”
রাষ্ট্রপতি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ত্রিশ লক্ষ মানুষ। হত্যা-নিপীড়নের ভয়াবহতায় এক কোটি বাঙালি আশ্রয় নিয়েছিল প্রতিবেশী দেশ ভারতে। একাত্তরের বীভৎস গণহত্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বমানবতার ইতিহাসেও একটি কালো অধ্যায়। এমন গণহত্যা আর কোথাও যাতে না ঘটে, গণহত্যা দিবস পালনের মাধ্যমে সে দাবিই বিশ্বব্যাপী প্রতিফলিত হবে।”
স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের উদ্যোগে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, “ইতোমধ্যে বেশ কিছু যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় ঘোষণা ও তা কার্যকর করা হয়েছে। আমি আশা করি, এ বিচার কার্যক্রম মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে সারাবিশ্বে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।” আবদুল হামিদ বলেন, “সকল বাধা পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলেছে উন্নতি আর সমৃদ্ধির পথে। দেশকে মধ্যম আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত করার প্রত্যয়ে গৃহীত ‘রূপকল্প-২০২১’ এর সফল পরিসমাপ্তি হতে চলেছে। বাংলাদেশকে ২০৪১ সালে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘রূপকল্প-২০৪১’ ঘোষণা করেছেন। “জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর যুগসন্ধিক্ষণে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে আমি দলমত নির্বিশেষে সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখার আহ্বান জানাচ্ছি। দেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত করার মধ্য দিয়েই আমরা একাত্তরের গণহত্যায় জীবনদানকারী প্রতিটি প্রাণের প্রতি জানাতে পারি আমাদের চিরন্তন শ্রদ্ধাঞ্জলি।”
গণহত্যা দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “২৫ মার্চে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কুশিলব, মানবতাবিরোধী অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের প্রেতাত্মারা আজো সমাজের আনাচে-কানাচে ঘোরাফেরা করছে, যারা স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানের দোসরদের আমাদের মহান সংসদে বসিয়েছিল এবং তাদের গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিয়ে বাঙালি জাতির গর্বিত ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছিল।” তিনি বলেন, “গণহত্যা দিবসের ৫০ বছর পূর্তিতে আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি- প্রয়োজনে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে হলেও ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ নির্যাতিত মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখব। জাতির পিতা যে অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কার্যকরী ভূমিকা রাখব, ইনশাআল্লাহ।”
গণহত্যা দিবস পালনে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। ২৫ মার্চ রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত সারাদেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাকআউট’ পালন করা হবে। তবে কেপিআই এবং জরুরি স্থাপনাগুলো এ কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে।
২৫ মার্চ রাতে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি কোনো স্থাপনায় কোনো আলোকসজ্জা করা যাবে না বলেও নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। তবে স্বাধীনতা দিবসে ২৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকে আলোকসজ্জা করা যাবে। জাতীয় জাদুঘরে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় গণহত্যা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। সারাদেশে আয়োজন করা হয়েছে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গীতিনাট্য এবং সাংস্কৃতিকঅনুষ্ঠানের।
ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনের মিনিপোলগুলোতে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে। এছাড়া ২৫মার্চ রাতে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এদিন বাদ জোহর দেশের সকল মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য উপাসনালয়গুলোতে সুবিধাজনক সময়ে প্রার্থনা করা হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসেও দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে কর্মসূচি পালন করা হবে।
ডিএ//
Leave a Reply