সারাদেশ ডেস্ক :
লাশটির দুই চোখ উপড়ানো। সমগ্র শরীর জুড়ে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আঘাতের স্পষ্ট চিহ্ন। সারা শরীরে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত। দু’ হাত পিছনে গামছা দিয়ে বাঁধা। লুঙ্গিটা ঊরুর উপরে কাছা মারার মতো করে আটকানো। হৃদপিন্ড আর কলিজাটা ছিঁড়ে ফেলেছে নিকৃষ্ট হত্যাকারীরা।
লাশটি ছিলো ছবির এই ভদ্রলোকের। বিশ্বখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট শহীদ অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বি।
এই সেই ফজলে রাব্বি, সমগ্র পাকিস্তানকে সাত বার বিক্রি করলেও যাঁর মস্তিষ্কের দাম উঠবে না৷ এই সেই ফজলে রাব্বি যিনি হতে পারতেন বাংলাদেশের প্রথম নোবেলজয়ী চিকিৎসা বিজ্ঞানী। তাঁর সে যোগ্যতা ছিলো।
তিনি ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। এমবিবিএস চূড়ান্ত পরীক্ষায় সমগ্র পাকিস্তানে শীর্ষস্থান দখল করা কৃতি ছাত্র।
১৯৬২ সালে মাত্র তিরিশ বছর বয়সে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ান-এর অধীনে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমআরসিপি ডিগ্রি নিয়েছিলেন ডা. ফজলে রাব্বি। তাও আবার একটি বিষয়ে নয়, বরং দুটিতে। যথাক্রমে (১) ইন্টারনাল মেডিসিন এবং (২) কার্ডিওলজিতে।
দেশে ফিরে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে।
মাত্র ৩২ বছর বয়সে ১৯৬৪ সালে মেডিসিনের উপর তাঁর বিখ্যাত কেস স্টাডি ‘A case of congenital hyperbilirubinaemia (DUBIN-JOHNSON SYNDROME) in Pakistan’ প্রকাশিত হয়েছিলে বিশ্বখ্যাত গবেষণা জার্নাল ‘জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন হাইজিন’-এ।
মাত্র ৩৮ বছর বয়সে, ১৯৭০ সালে তাঁর বিশ্বখ্যাত গবেষণা Spirometry in tropical pulmonary eosinophilia প্রকাশিত হয়েছিলো ব্রিটিশ জার্নাল অফ দা ডিসিস অফ চেস্ট ও ল্যান্সেট এ।
১৯৭০ সালে মাত্র ৩৮ বছর বয়সেই ডা. ফজলে রাব্বি মনোনীত হয়েছিলেন পুরো পাকিস্তানের সেরা অধ্যাপক পুরস্কারের জন্য। কিন্তু তাঁর আত্মায় ছিলো বাংলার অসহায় আর্ত মানুষ। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছিলেন তিনি সেই পুরষ্কার।
মাত্র ৩৯ বছর বয়সী ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রফেসর অব ক্লিনিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড কার্ডিওলজিস্ট।
আজকের দিনে কল্পনা করা যায়!
মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় তিনি আহত মানুষদের সেবা দিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল-এ বসে। বেশ কয়েকদফা নিজের সাধ্যের চেয়ে বেশি ঔষধ আর অর্থ সহায়তা দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় গোপন রেখে দিয়েছিলেন চিকিৎসাও।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর ডা. ফজলে রাব্বির স্ত্রী জাহানারা রাব্বী একই স্বপ্ন দুবার দেখলেন। স্বপ্নটা এমন, একটা সাদা সুতির চাদর গায়ে তিনি তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে জিয়ারত করছেন এমন একটা জায়গায়, যেখানে চারটা কালো থামের মাঝখানে সাদা চাদরে ঘেরা কী যেন একটা বস্তু।
১৫ ডিসেম্বর সকালে ঘুম থেকে জেগে জাহানারা রাব্বি স্বামীকে এই স্বপ্নের কথা খুলে বললেন। জবাবে ফজলে রাব্বি মৃদু হেসে বললেন, ‘তুমি বোধ হয় আমার কবর দেখেছো’। শুনে ভয় পেয়ে আঁতকে উঠলেন জাহানারা রাব্বি।
টেলিফোন টেনে পরিচিত অধ্যাপকদের কারো কারো বাড়িতে ফোন করতে বললেন, দেশের অবস্থা জানার জন্য। ডা. রাব্বি ফোন করলেন। কিন্তু কারো বাড়িতেই সংযোগ পাওয়া যাচ্ছিলো না। একসঙ্গে কাউকেই পাওয়া যাচ্ছেনা, বিষয়টিতে খানিকটা অবাক হলেন জাহানারা রাব্বি।
নাস্তার পর, তাঁরা খেয়াল করলেন আকাশে ভারতীয় বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান উড়ছে। কাছেই কোথাও বিমান থেকে বোমা হামলা হলো। বিকট শব্দের আওয়াজ। চমকে উঠলেন জাহানারা রাব্বী।
সকাল ১০টার দিকে জানা গেল দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ উঠে গেছে। এমন সময়ে ফজলে রাব্বি তাড়াহুড়োর গলায় স্ত্রীকে বললেন, ‘পুরান ঢাকায় যেতে হবে একবার। এক অবাঙালি রোগীকে দেখতে যাবো। দেখেই ফিরে আসবো।’
শুনেই জাহানারা রাব্বি বললেন, ‘ওখানে যাওয়ার কাজ নেই। দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ। ওরাই তো পাকিস্তানীদের সঙ্গ দিচ্ছে।’
জবাবে ফজলে রাব্বি হালকা হেসে বললেন, ‘ভুলে যাচ্ছো কেনো, সে ও মানুষ।’ জাহানারা রাব্বি বললেন, ‘তুমি যে রোজ বলো আজই তারা আত্মসমর্পণ করবে। তো মিরপুর মোহাম্মদপুরের লোকদের আমরা ক্ষমা করতে পারব?’ গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে ডা. রাব্বি বললেন, ‘আহা, বললাম তো, ওরাও মানুষ! তাছাড়া ওদের দেশ নেই। ওরা যাবে কোথায়! ওদের দেখবে কারা?” জাহানারা রাব্বি বললেন, কিন্তু এতসবের পর ওদেরকে আমরা কেমন করে ক্ষমা করবো?’ জবাবে ফজলে রাব্বী বললেন, ‘হ্যাঁ ক্ষমাও করবে এবং আমাদের স্বাধীন দেশে থাকতেও দেবে।’
সেদিন ডা. ফজলে রাব্বি বাসায় ফিরে এসেছিলেন ফের কারফিউ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই। দুপুরের খাবার ছিলো আগের দিনের বাসি তরকারি। কিন্তু ডা. রাব্বী উল্টো বলেছিলেন, ‘আজকের দিনে এতো ভালো খাবার খেলাম!’
জাহানারা রাব্বি এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। সবাই পরামর্শ দিয়েছেন, দেশের এই অবস্থায় এখানে থাকাটা বিপজ্জনক। জাহানারা রাব্বি স্বামীকে বললেন, ‘চলো এখনই চলে যাই।’ ডা. ফজলে রাব্বি বলেছিলেন ‘আচ্ছা, দুপুরটা একটু গড়িয়ে নিই। বিকেলের দিকে না হয় বেরোনো যাবে। তাছাড়া যাবোই বা কোথায়! হাসপাতাল, রোগী, এতো এতো আর্ত মানুষ!!!’
কিছুক্ষণ পর বাবুর্চি এসে খবর দিলো, ‘সাহেব, বাড়ি ঘিরে ফেলেছে ওরা।’ সিদ্ধেশ্বরীর বাসার বাইরে তখন কাদালেপা মাইক্রোবাস ও একটি জীপ দাঁড়িয়ে। মাইক্রোবাসের সামনে বেশ কয়েক জন তরুণ। পাশের জীপে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানী সৈন্য দাঁড়িয়ে। যে আশংকা করছিলেন জাহানারা রাব্বি, ঠিক তাই হলো।
খুব হালকা ভয়ার্ত স্বরে, ফজলে রাব্বি জাহানারা রাব্বির দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘টিঙ্কুর আম্মা, ওরা আমাকে নিতে এসেছে।’ এরপর দারোয়ানকে গেট খুলে দিতে বললেন।
যখন মাইক্রোবাসে তিনি উঠলেন তখন ঘড়িতে সময় বিকেল চারটা। শীতের বিকেলে মরে আসা আলো। ঝুপ করে আঁধার নামবে। কি মায়াময় গোধুলি লগ্নের শহুরে ছবি!
আর….কি অদ্ভুত অনাচার! কি বিপর্যস্ত মনুষ্যত্ব! মানবতার কতবড় স্খলন! বিচারহীনতার কি নিকৃষ্ট উদাহরণ!
১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ ডা. ফজলে রাব্বির লাশটি পাওয়া গিয়েছিলো রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। প্রথমেই বলেছি, দুই চোখ উপড়ানো। সমগ্র শরীর জুড়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আঘাতের চিহ্ন। দু’ হাত পিছনে গামছা দিয়ে বাঁধা। লুঙ্গিটা উরুর উপরে আটকানো। তাঁর হৃদপিন্ড আর কলিজাটা ছিঁড়ে ফেলেছে হানাদার ও নিকৃষ্ট আলবদর, আল শামস, রাজাকার এবং পাকিস্তানী আর্মিরা।
এই সেই ডা. ফজলে রাব্বি, যাঁর গোটা হৃদয় জুড়ে ছিলো বাংলাদেশ আর দেশের অসহায় আর্ত মানুষ। যাঁর অন্তর জুড়ে ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। হানাদার ও আল বদরের ঘৃণ্য নরপিশাচেরা সেই হৃদয়কে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেললেও, হৃৎপিণ্ডটা উপড়ে ফেললেও, বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় থেকে কি তাঁকে বিছিন্ন করা গেছে?
কখনো কি যাবে? তিনি আছেন, তিনি থাকবেন আমাদের প্রাণে, হৃদয়ের গহীনে।
বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এই কিংবদন্তি শহীদ বুদ্ধিজীবীকে।
সংগৃহীত/ডিএএম//
Leave a Reply