সারাদেশ ডেস্ক :
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভারতকে অনুরোধ করেছেন বলে বক্তব্য দিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার টিকিয়ে রাখতে ভারতকে অনুরোধ করেছেন বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেই বক্তব্য নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার, ভারত যেন তা করে সেজন্য তিনি ভারতের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন।
হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা বলেছেন, এ ধরনের বক্তব্য তাদেরকে বিব্রত করেছে। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, এই বক্তব্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য শেখ হাসিনা, সরকার এবং আওয়ামী লীগের জন্য চরম বিব্রতকর।
কী বলেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন?
চট্টগ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্মাষ্টমী উৎসবের অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। বৃহস্পতিবার রাতে সেই অনুষ্ঠানে তিনি তার বক্তৃতায় বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেন।
সেখানে মি: মোমেন বলেন, সম্প্রতি তিনি দিল্লি সফরে গিয়েছিলেন, তখন তিনি বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভারতকে অনুরোধ করেছেন।
“আমি ভারতে গিয়ে যেটি বলেছি যে শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।”
চট্টগ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেছিলেন যে, “আজকে অনেকের বক্তব্য এসেছে যে শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাঁকে (শেখ হাসিনা) টিকিয়ে রাখলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে যাবে। আমাদের দেশ সত্যিকারভাবে অসাম্প্রদায়িক দেশ হবে।
“সেজন্য শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করার, সেজন্য ভারতবর্ষ সরকারকে আমি সেই সেই অনুরোধ করেছি,” বক্তব্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। সরকার এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেও তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে বলে দলটির সিনিয়র একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
ব্যাপক সমালোচনার মুখে ওই বক্তব্যের ব্যাপারে শুক্রবার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
তিনি চট্টগ্রাম থেকে শুক্রবার গোপালগঞ্জে যান বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানাতে। সেখানে তিনি তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে স্থিতিশীলতার প্রশ্নে তিনি ভারত সরকারের সাহায্য চেয়েছেন।
মি: মোমেন বলেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্সের কারণে ভারতে আসাম মেঘালয়সহ দেশটির উত্তর পূর্বাঞ্চলে সন্ত্রাসী তৎপরতা নেই। ভারতের ঐ অঞ্চলে উন্নয়ন হচ্ছে।
তিনি উল্লেখ করেন, এই বিষয়টি আসামের মুখ্যমন্ত্রী তাকে বলেছিলেন এবং এজন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।
মি: মোমেন ভারতে যখন গিয়েছিলেন, তখন তিনি আসামের মুখ্যমন্ত্রীর সেই বক্তব্য তুলে ধরে ভারতকে বলেছিলেন যে, “আপনাদের আসামের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে শেখ হাসিনা থাকায় স্থিতিশীলতা এসেছে। স্থিতিশীলতা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
“আমি বলেছি, শেখ হাসিনা এবং আমরা স্থিতিশীলতার ব্যাপারে বদ্ধ পরিকর। এ ব্যাপারে আপনারা সাহায্য করলে আমরা খুব খুশি হব,” তার ব্যাখ্যায় বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের দায় নেবে না আওয়ামী লীগ
মি: মোমেনের এই ব্যাখ্যার পরও তার বক্তব্যের দায়িত্ব সরকার এবং আওয়ামী লীগ নিতে রাজি নয়।
দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সিনিয়র মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ঐ বক্তব্য সরকার বা আওয়ামী লীগের নয়, এটি মি: মোমেনের ব্যক্তিগত বক্তব্য।
অন্যদিকে, বিরোধীদল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, একজন মন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যের ব্যাপারে সরকারকে ব্যাখ্যা দিতে হবে।
হিন্দু সম্প্রদায় ‘বিব্রত’
চট্টগ্রামে যে সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঐ বক্তব্য দিয়েছেন, সেই হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম একজন নেতা রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, এ ধরনের বক্তব্য তাদের জন্য বিব্রতকর।
মি: দাশগুপ্ত বলেন, “তিনি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে তাদের সামনে এ বক্তব্যটি রাখলেন, যাদের সম্পর্কে এক ধরনের অপপ্রচার আছে যে এরা ভারতের দালাল। যদিও বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়-তারা কখনও অন্য দেশের দালালি করে না এবং দালালের অবস্থান তারা গ্রহণ করে না।
“সেখানে আমাদের কাছে মনে হয়েছে যে এ বক্তব্যগুলো সাধারণভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে বিব্রতকর। এবং সবাই কিন্তু এই একই কথা বলছেন” মন্তব্য রানা দাশগুপ্তের।
‘পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য লজ্জাজনক’
বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা রকম আলোচনা হয়ে থাকে।
কিন্তু যখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভারতকে অনুরোধ করেছেন বলে বক্তব্য দেন, তখন সেটা দেশের জন্যই বিব্রতকর।
ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য সরকার এবং আওয়ামী লীগকে গভীর বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে।
মি: আনাম উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ সরকার ভারতের ওপর নির্ভরশীল বা ভারতের বিরাট প্রভাব বাংলাদেশের ওপর আছে-এসব কথা সরকার বিরোধীরা আওয়ামী লীগ সম্পর্ক বলে থাকে। সেই প্রেক্ষাপটে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য লজ্জাজনক।
“উনি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) বলছেন, আমি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) গিয়ে বলে আসলাম, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য যা কিছু করেন। এটাতো অত্যন্ত লজ্জাজনক একটা ব্যাপার এবং বিব্রতকর। বাংলাদেশের জন্যেতো বটেই, ভারতের জন্যও,” বলেন মি. আনাম।
এক বছরের কিছু সময় পরে যখন বাংলাদেশে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে, তার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এধরনের বক্তব্যকে একটা “অপরিপক্ক রাজনেতিক বক্তব্য” বলে মনে করেন মি: আনাম।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি-এটা সত্যি সত্যি সরকারকে বেশ গভীরভাবে বিব্রত করবে।”
এদিকে, সপ্তাহখানেক আগেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে “দেশের মানুষ বেহেশতে আছে” বলে মন্তব্য করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
Leave a Reply