দুই শিশু জাপানি মায়ের কাছে থাকবে : আপিল বিভাগ
- Update Time : ১২:৫৯:৪০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২২
- / ৩ Time View
নিজস্ব প্রতিবেদক :
আলোচিত জাপানি বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি দুই কন্যাশিশু আপাতত তাদের মা জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকোর হেফাজতেই থাকবে বলে আদেশ দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ।
শিশু দুটি বিষয়ে ঢাকার পারিবারিক (সহকারী জজ) আদালতে বিচারাধীন মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তারা মায়ের কাছেই থাকবে। একইসঙ্গে তিন মাসের মধ্যে পারিবারিক আদালতকে মামলাটি নিষ্পত্তিরও নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ আজ এই আদেশ দেন।
আদালতে শিশুদের মায়ের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি, আহসানুল করিম ও মোহাম্মদ শিশির মনির। শিশুদের বাবার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী ফিদা এম কামাল, ফাওজিয়া করিম ফিরোজ ও ব্যারিষ্টার অনীক আর হক।
আপিল বিভাগের আদেশে গত বছর ১২ ডিসেম্বর থেকে মায়ের হেফাজতেই রয়েছে কন্যাশিশু দুটি। তবে শিশু দুটির বাবা প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে সুবিধাজনক সময়ে তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন।
গতবছর ২১ নভেম্বর হাইকোর্ট জাপানি দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা বাংলাদেশে তাদের বাবা ইমরান শরীফের হেফাজতে থাকবে বলে রায় দেন। এতে বলা হয়, যেহেতু মা জাপানি নাগরিক, সেখানে থাকেন এবং কাজ করেন, তাই তিনি নিজের সুবিধামতো সময়ে বাংলাদেশে এসে বছরে তিনবার ১০ দিন করে দুই সন্তানের সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে পারবেন। হাইকোর্টের এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন মা। এ আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে গতবছর ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টার মধ্যে মায়ের কাছে শিশু দুটিকে হস্তান্তর করতে তাদের বাবাকে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।
কিন্তু তাদের বাবা ইমরান শরীফ এই নির্দেশনা প্রতিপালন না করায় পরদিন ১৩ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। এ অবস্থায় সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে গতবছর ১৩ ডিসেম্বর এক আদেশে শিশু দুটিকে মায়ের কাছে দিতে নির্দেশনা বহাল রাখা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময়ে দেয়া আদেশে মায়ের হেফাজতে রাখার সময়সীমা বাড়ানো হয়।
জাপান থেকে কন্যা শিশু দুটিকে নিয়ে গতবছর ২১ ফেব্রুয়ারি দুবাই হয়ে বাংলাদেশে আসেন তাদের পিতা ইমরান শরীফ। দেশে ফিরে সন্তান দুটিকে ঢাকায় স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন।
এ অবস্থায় গতবছর ১৮ জুলাই এরিকো শ্রীলংকা হয়ে বাংলাদেশে আসেন। এরপর বাংলাদেশের হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন তিনি। এ আবেদনে হাইকোর্টের আদেশের পর গতবছর ২২ আগস্ট রাতে শিশু দুটিকে তাদের বাবার বাসা থেকে উদ্ধার করে তেজগাঁও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখে সিআইডি পুলিশ।
৩১ আগস্ট একই হাইকোর্ট বেঞ্চ সেই দুই কন্যা শিশুকে গতবছরের ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাপানি মা ও বাংলাদেশি বাবার সঙ্গেই গুলশান এক নম্বরে চার কক্ষের একটি ভাড়া বাসায় থাকার নির্দেশনা দেন। এরপর শিশু দুটিকে তেজগাঁও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে ওই বাসায় স্থানান্তর করা হয়। পরে দেওয়া হয় মায়ের হেফাজতে।
এরিকোর আইনজীবী শিশির মনির জানান, ২০০৮ সালের ১১ জুলাই জাপানি নাগরিক ডা. এরিকো নাকানো (৪৬) ও বাংলাদেশি আমেরিকান নাগরিক শরীফ ইমরান (৫৮) জাপানি আইনানুসারে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তারা টোকিওতে বসবাস শুরু করেন। ১২ বছরের সংসারে তিনজন কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তারা হলো- জেসমিন মালিকা (১১), লাইলা লিনা (১০) ও সানিয়া হেনা (৭)। এরিকো পেশায় একজন চিকিৎসক। তিন মেয়ে টোকিওর চফো সিটিতে অবস্থিত আমেরিকান স্কুল ইন জাপানের (এএসজেআই) শিক্ষার্থী ছিল।
২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি ইমরান তার স্ত্রী এরিকোর সঙ্গে ডিভোর্স আবেদন করেন। এরপর ২১ জানুয়ারি ইমরান স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে তার মেয়ে জেসমিন মালিকাকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন। কিন্তু তাতে এরিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ তার প্রস্তাব নাকচ করে। পরে স্কুলবাসে বাড়ি ফেরার পথে বাস স্টপেজ থেকে ইমরান তাদের বড় দুই মেয়ে জেসমিন ও লিনাকে অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান।
চারদিন পর ২৫ জানুয়ারি ইমরান তার আইনজীবীর মাধ্যমে এরিকোর কাছে সন্তানদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করেন। কিন্তু এরিকো তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর মধ্যে ২৮ জানুয়ারি এরিকো টোকিওর পারিবারিক আদালতে তার সন্তানদের জিম্মার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ চেয়ে মামলা করেন। আদালত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক সাক্ষাতের আদেশ দেন। ইমরান আদালতের আদেশ ভঙ্গ করে মাত্র একবার মায়ের সঙ্গে দুই মেয়ের সাক্ষাতের সুযোগ দেন।
এদিকে ৯ ফেব্রুয়ারি মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ইমরান তার মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেন এবং ১৭ ফেব্রুয়ারি নতুন পাসপোর্ট নেন। পরে ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি দুই মেয়ে জেসমিন ও লিনাকে নিয়ে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। ৩১ মে টোকিওর পারিবারিক আদালত এরিকোর অনুকূলে জেসমিন ও লিনার জিম্মা হস্তান্তরের আদেশ দেন। পরে ছোট মেয়ে সানিয়া হেনাকে মায়ের কাছে রেখে ১৮ জুলাই এরিকো শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশে আসেন।
পরে তিনি হাইকোর্টে রিট করেন। তারই ধারাবাহিকতায় আদালত গুলশানে একটি ভাড়া বাসায় সবাইকে আলাদা কক্ষে বসবাসের অনুমতি দেন। পাশাপাশি সমঝোতা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। কিন্তু উভয়পক্ষের আইনজীবীরা কয়েকবার বৈঠকেও সমঝোতায় আসতে পারেনি। ৩০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট মেয়েদের এরিকোর সঙ্গে গুলশানের বাসায় থাকার আদেশ দেন।
আর বাবা ইমরান শরীফকে দিনের বেলা তাদের সঙ্গে দেখা ও সময় কাটাতে পারবেন বলে সুযোগ দেন। পরে ৩১ অক্টোবর ২ রিটের শুনানি শেষে ২১ নভেম্বর রায় দেন হাইকোর্ট। সে রায়ের বিষয়ে আমরা আপিল বিভাগে আবেদন করি।
ডিএএম/এসএম//