সেই বিচারকের ফৌজদারি বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিলেন আপিল বিভাগ
- Update Time : ০৬:৩৫:৪০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২২ নভেম্বর ২০২১
- / ১ Time View
সুপ্রিমকোর্ট প্রতিবেদক:
বিচারিক দায়িত্ব থেকে সাময়িকভাবে প্রত্যাহার হয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত মোছা. কামরুন্নাহারের ফৌজদারী বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে (সিজ) নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতির ভার্চুয়াল বেঞ্চে আজকের কার্যতালিকার ১ নম্বরে ‘রাষ্ট্র বনাম আসলাম সিকদার’ মামলাটি আদেশের জন্য আসে। এই মামলাকে কেন্দ্র করে আজ সোমবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আপিল বিভাগে হাজির হন রেইনট্রি মামলার রায়ের পর সমালোচনার মুখে বিচারিক দায়িত্ব থেকে সাময়িক প্রত্যাহার হওয়া বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার। এক পর্যায়ে আজকের বিচারিক কার্যক্রম শুরুর আগে আদালত কক্ষ থেকে গণমাধ্যমকর্মী, আইনজীবী ও আদালতের কর্মকর্তাদের বের হয়ে যেতে বলা হয়। এরপর রুদ্ধদ্বার আদালত থেকে বেলা ১১টার দিকে বের হন বিচারক মোছা: কামরুন্নাহার।
সুপ্রিমকোর্টের মুখপাত্র ও বিশেষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বাসস’কে জানান, “আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে বর্তমানে সংযুক্ত এবং ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর সাবেক বিচারক বেগম মোছা: কামরুন্নাহার অদ্য ২২ নভেম্বর সকাল সাড়ে নয়টায় সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে সশরীরে উপস্থিত হন। আপিল বিভাগের কার্যতালিকার ১ নং ক্রমিকের মামলায় শুনানিঅন্তে – তাহার ফৌজদারী বিচারিক ক্ষমতা সিজ (seize) করা হয়েছে- মর্মে আদেশ প্রদান করেন। পূর্ণাঙ্গ রায় পরবর্তীতে প্রকাশ হবে।”
ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলায় ২০১৯ সালের ১৮ জুন হাইকোর্ট থেকে জামিন পান বেসরকারি একটি টেলিভিশনের সাবেক অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক আসলাম সিকদার। ওই জামিন আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের চেম্বার কোর্ট ওই বছরের ২৫ জুন জামিন স্থগিত করে বিষয়টি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান।
আবেদনটি আপিল বিভাগে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় গত বছরের ২ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ ওই আসামিকে জামিন দেন। সর্বোচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের পরও আসামিকে জামিন দেয়ার বিষয়টি আদালতের নজরে আনে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর আপিল বিভাগ এবিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে মোছা. কামরুন্নাহারকে তলব করেন।
ওই বছরের ২ এপ্রিল তাকে আপিল বিভাগে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে আসলাম সিকদারকে দুই সপ্তাহের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। এর আগে ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ধর্ষণের অভিযোগে আসলাম সিকদারের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় মামলা হয়। সে মামলায় ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫ এর দেয়া রায়ে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আসলাম সিকদারকে খালাস দেয়া হয়। তবে খালাসের ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
এদিকে চার বছর আগে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলায় ১১ নভেম্বর রায় দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার। ওই রায়ে পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দেয়া হয়। খালাস পাওয়া পাঁচজন হলেন আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ, তার বন্ধু সাদমান সাকিফ, নাঈম আশরাফ, সাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন।
আলোচিত এই রায়ের পর আইনজীবীদের বরাতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয় যে, ‘রায় ঘোষণার সময় বিচারক এই পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে পুলিশ যেন মামলা না নেয়।’ এমন খবরের পর রায়ের ওই পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা।
‘৭২ ঘণ্টা পরে পুলিশ যেন কোনো ধর্ষণ মামলার এজাহার না নেয়’- রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায়ে এমন পর্যবেক্ষণ দেয়া বিচারক মোছা.কামরুন্নাহারকে প্রত্যাহার করে আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে ১৪ নভেম্বর এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে আইন মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭, ঢাকা এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) বেগম মোছা. কামরুন্নাহারকে বর্তমান কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহারপূর্বক আইন ও বিচার বিভগে সংযুক্ত করা হলো।
এর আগে সুপ্রিমকোর্টের মুখপত্র ও বিশেষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান জানান, “১৪ নভেম্বর রোববার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সেই বিচারপতি আর আদালতে বসতে পারবেন না। তার বিচার ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে তাকে বর্তমান কর্মস্থল থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করতে চিঠি পাঠিয়েছে সুপ্রিমকোর্ট।” সুপ্রিমকোর্ট মূখপত্র বলেন, প্রধান বিচারপতি সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিগনের আলোচনাক্রমে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক বেগম মোছা: কামরুন্নাহারকে ১৪ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৯ টা হতে আদালতে না বসার নির্দেশ প্রদান করেছেন । তার বিচার ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে তাকে বর্তমান কর্মস্থল হতে প্রত্যাহার করে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট হতে আইন মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করা হয়।
১৩ নভেম্বর শনিবার আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক এমপি বলেন, বনানীর রেইনট্রি ধর্ষণ মামলার বিচারকের পাওয়ার সিজ (কেড়ে নেয়া) করতে প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দেয়া হবে।
প্রয়াত সিনিয়র আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদারের স্মরণ সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান শেষে সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এ কথা বলেন। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘একটি কথা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, আমি ওনার রায়ের বিষয়বস্তু নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। আমি শুধু ওনার এই যে অবজারভেশন (৭২ ঘন্টা পরে পুলিশ যেন কোন ধর্ষণ মামলার এজাহার না নেয়) এই যে বক্তব্য দিয়েছেন, এটা সম্পূর্ণ বেআইনী এবং অসাংবিধানিক। এবং এই কারণে আমি প্রধান বিচারপতির কাছে তার বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন (ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার) নিয়ে যেন ব্যবস্থা নেয়া হয় সেজন্য একটা চিঠি লিখছি।’
ডিএএম/এসএম//