নিজস্ব প্রতিবেদক :
দাঁতে ক্ষয় রোধে করণীয় সম্পর্কে সারাদেশের সঙ্গে (saradesh.net) কথা বলেছেন ডেন্টাল সার্জন ডা: সৈয়দা ফারজানা আফরিন।
ডাঃ আফরিন রাজধানীর রামপুরা বনশ্রীর ব্লক-বি, রোড-৫-এর ৩৬ নম্বর বাড়ীতে স্থাপিত আফরিন ডেন্টাল কেয়ারের প্রধান কনসালটেন্ট।
ডাঃ আফরিন বলেন, বিভিন্ন কারণে দাঁত ক্ষয় হয়। তবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে জটিলতা এড়িয়ে দাঁতকে ভালো রাখা যায়।
প্রশ্ন : সাধারণত কী কী কারণে দাঁতের ক্ষয়রোগ হতে পারে?
ডাঃ আফরিন : বিভিন্ন কারণে দাঁত ক্ষয় হয়। প্রথমত সঠিকভাবে দাঁত ব্রাশ না করার কারণে দাঁত ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। মজার বিষয় হলো আমরা দাঁত ব্রাশ করি একে যত্নে রাখার জন্য। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ভুলভাবে ব্রাশ করার কারণে দাঁত ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। ব্রাশ করার উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়ে উল্টো দাঁত ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। অনেকে দীর্ঘ সময় ধরে শক্ত ধরনের ব্রাশ ব্যবহার করছে। ব্রাশ করার সময় হয়তো খসখস শব্দ করছে, আমরা অনেক দূর থেকে সেই শব্দ শুনতে পাচ্ছি। সঠিক উপায়ে ব্রাশ করতে পারছে না এ কারণে তার দাঁত ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে।
ডাঃ আফরিন বলেন, অভ্যাসগত কারণে অনেকে দাঁত দিয়ে হাতের নখ কাটছে। সে ক্ষেত্রেও দাঁত ক্ষয় হয়ে যায়। আবার দেখা যায়, সুতো দাঁত দিয়ে কাটে, এতে দাঁত ক্ষয় হয়ে যায়। আবার দেখা যায়, ঘুমের মধ্যেও অনেকের দাঁত কামড়ানোর অভ্যাস থাকে, এই বদঅভ্যাসগুলোর কারণেও অনেকের দাঁত ক্ষয় হয়ে যায়। মানুষ পান-সুপারি, জর্দা ইত্যাদি খায়। অথবা শক্ত কোনো খাবার ইচ্ছামতো চিবিয়ে খায়, এ ক্ষেত্রেও দাঁত ক্ষয় হয়। বিভিন্ন খাদ্য খাওয়ার ফলে রাসায়নিক জিনিসের কারণে দাতের ক্ষয় হয়। যেমন : বিভিন্ন ফল, জুস ইত্যাদি। আবার দাঁতের এবরেশনের কারণে সমস্যা হচ্ছে। দাঁতের ফাঁকে খাদ্যকণা জমে থাকলে, এটি যদি আমরা বের করতে না পারি সে ক্ষেত্রে পরবর্তী কালে এটি ধীরে ধীরে পাথর হয়ে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রেও দাঁত ক্ষয় হয়ে যায়।
প্রশ্ন : প্রধান যে দাঁত ক্ষয়ের কারণ, যেটাকে ‘ডেন্টাল ক্যারিজ’ বলছি-এর প্রধান কারণগুলো কী?
ডাঃ আফরিন : ভুলভাবে ব্রাশের কারণেও এখানে সমস্যা হয়। আরেকটি বিষয় হলো, আমরা যে খাবার খাচ্ছি এতে কার্বোহাইড্রেট বা সুগার থাকে। যদি খাবার আটকে থাকে এবং একে বের না করা হয় এখানে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করবে। আমরা যদি দাঁতের গঠন চিন্তা করি, প্রথম এনামেল, এরপর ডেনটিন। তাহলে এখানে প্রথমে এনামেল ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ডেনটিন ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে ক্যারিজ হচ্ছে।
প্রশ্ন : প্রথমে যখন এনামেল ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে-তখন এটি কীভাবে প্রকাশ পায়?
ডাঃ আফরিন: দেখা যায় আমাদের ক্লিনিকে যখন অনেক রোগী আসে তারা অভিযোগ করে ছোটবেলায় দাঁত অনেক সাদা ছিল তবে এখন হলুদ হয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি এনামেলের রং সাদা। ঠিক এনামেলের নিচের যে অংশটুকু রয়েছে এটা হলুদ। এনামেল যখন ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে ডেনটিন বের হচ্ছে। তখন স্বাভাবিক ভাবেই হলুদ রং বের হয়ে আসছে। রোগী তখন মনে করে হয়তো আমি দাঁত ঠিকমতো ব্রাশ করছি না বলে হলুদ হয়ে যাচ্ছে। তখন রোগী আরো জোরে দাঁত ব্রাশ করা শুরু করে দেয়। তখন আরো ক্ষয় হয়ে যায়। আরো হলুদ হয়ে যায়। যখনই ধীরে ধীরে হলুদ হয়ে যাচ্ছে, এর কারণ এনামেল ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে এবং পরবর্তীকালে অনেক রোগী অভিযোগ করে আমার দাঁত শির শির করছে। যেহেতু ডেনটিনে স্পর্শকাতরতা তৈরি করছে। যেহেতু এটার নিচে পাল্প বা মজ্জা রয়ে গেছে তাই এই সমস্যা হয়।
প্রশ্ন: যখন এই গর্তটা এনামেল, ডেনটিন ভেদ করে পাল্পে পৌঁছে যায় তখন কী হয়?
ডাঃ আফরিন : তখন রোগী ভীষণ রকম দাঁত ব্যথা অনুভব করে। তখন আর উপায় না দেখে দাঁতের চিকিৎসকের কাছে তারা চলে আসে। তবে তখন না এসে আরো আগেই চিকিৎসকের কাছে আসা উচিত ছিল। এতে তাদের জন্য ভালো হতো। কারণ শুরুতে এলে শুধু ফিলিং করে দিলেই চলত। এখন তাকে আরো বিশদ চিকিৎসায় যেতে হবে।
ডাঃ আফরিন বলেন, দাঁতে ব্যথা হচ্ছে না, কেবল খাবার আটকে থাকছে-এই সময়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে আমরা একটি ফিলিং করে দেই।
প্রশ্ন : রাসায়নিক কারণে বা দাঁতে দাঁত ঘষা লেগে যে ক্ষয় হয় এ ক্ষেত্রে আপনাদের পরামর্শ কী থাকে?
ডাঃ আফরিন : ঘুমের মধ্যে যার দাঁত কামড়ানোর অভ্যাস আছে তাদের এটা পরিত্যাগ করতে হবে। একদিনে সে পারবে না। সে ক্ষেত্রে রিটেইনার নামক এক ধরনের ডিভাইস কিনতে পাওয়া যায় যেটা সে রাতে ঘুমের মধ্যে দিয়ে ঘুমাবে। এটা ধীরে ধীরে বাদ দিতে দিতে দেখা যাবে দাঁত কামড়ানোর অভ্যাস সে ত্যাগ করতে পারছে।
প্রশ্ন : যাদের ইতিমধ্যেই ক্ষয় শুরু হয়েছে-সেক্ষেত্রে আপনাদের কী পরামর্শ?
ডাঃ আফরিন: সেক্ষেত্রে পুরোপুরি ঠিক করা সম্ভব না। সে ক্ষেত্রে কৃত্রিম কাজ করতে হবে। দেখতে হবে কোন অবস্থায় আছে। যদি এনামেল ক্ষয় হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে তেমন কিছু হবে না। আর যদি ডেনটিন ক্ষয় হয়ে যায় অবশ্যই চিকিৎসা করতে হবে। আর শক্ত খাবার কমিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। পান সুপারি খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করা উচিত।
প্রশ্ন : ব্যথা শুরু হওয়ার পর আপনারা কী পরামর্শ দেন?
ডাঃ আফরিন: সে ক্ষেত্রে রুট ক্যানেল চিকিৎসা ছাড়া আর উপায় নেই। মজ্জা বা পাল্পে গিয়ে যখন লেগে যায় সে ক্ষেত্রে আর ফিলিংয়ে কাজ হবে না। পাল্পকে পুরোপুরি বের করে ফেলতে হবে। রুট ক্যানেল শুরুর পূর্বে দাঁতের বিস্তারিত বুঝতে একটি পূর্ণাঙ্গ এক্সরে করানোরও প্রয়োজন পড়ে।
প্রশ্ন: রুট ক্যানেল চিকিৎসার প্রতি ভয় কাজ করে। এটা কেন?
ডাঃ আফরিন : অনেকের মধ্যে ভয় কাজ করে। তারা মনে করে এতে অনেক ব্যথা পাবে। বা ছোট ছোট যন্ত্র মুখে দিয়ে কীভাবে এটা ঠিক করবে? এর জন্য একটি মানসিক সমস্যা থেকে যায়। এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে রুট ক্যানেল করা হয়। যা সম্পূর্ণ ব্যাথামুক্ত। আমরাই এখন এ চিকিৎসা করি।
প্রশ্ন : রুট ক্যানেল করার পর দাঁতকে যেন ভালো করে রাখা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ কি?
ডাঃ আফরিন : রুট ক্যানেল করার পরার ক্যাপ বা ক্রাউন পড়ে নিতে হবে।
প্রশ্ন : দাঁতের ক্ষয় রোগ যেন না হয়, সে ক্ষেত্রে প্রতিরোধের জন্য কী করণীয়?
ডাঃ আফরিন: সঠিক উপায়ে দাঁত ব্রাশ করতে হবে। নরম টুথব্রাশ নিয়ে, গুণতগত মানের পেস্ট নিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে হবে। এক থেকে দুই মিনিট ব্রাশ করতে হবে। সঠিক উপায়ে ব্রাশ করার বিষয়টি জানতে হবে। দ্বিতীয়ত, দাঁতের ফাঁকের ময়লা পরিষ্কার করতে হবে। নাইলন নামে একটি সুতো আছে, যেটি ডেন্টাল ফ্লস নামে চিকিৎসা বিজ্ঞানে পরিচিত। এটা দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করতে হবে। জিহ্বা পরিষ্কার করতে হবে। মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করতে পারে। আর সুতা কাটা বা নখ দাঁত দিয়ে কাটার অভ্যাসগুলো পরিত্যাগ করতে হবে।
প্রশ্ন: কয় দিন পরপর দাঁতের চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে?
ডাঃ আফরিন : সমস্যা হোক বা না হোক, বছরে দুবার অর্থাৎ ছয় মাস পর পর চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। তাহলে শুরুর দিকে সমস্যা জেনে গেলে সে আর ভুগবে না। তবে আমাদের দেশে সমস্যা বা ব্যাথা মারাত্মক হলেই বাধ্য হয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। অন্যতায় এখনো দাঁত বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে।
প্রশ্ন : স্কেলিং সম্বন্ধে অনেকের একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। কেন?
ডাঃ আফরিন : আসলে নিয়ম হলো, বছরে একবার সাধারণ স্কেলিং করা। দেখা যায়, কেউ ৩০ বা ৪০ বছর পর হঠাৎ স্কেলিং করতে আসল। দেখা গেল তার দাঁতে ক্যালকুলাস বা পাথর দিয়ে ভর্তি। দাঁত এবং মাড়ির সংযোগ স্থলে ক্যালকুলাস লেগে থাকে। যখন পাথরটি ভেতরে ঢুকে যায় দাঁত থেকে মাড়িটা আলাদা হয়ে যায়। আমার কাছে যখন আসবে তখন পাথর ফেলে দিতে হবে স্বাভাবিকভাবে। তখন হয়তো দাঁত এবং মাড়ি আলাদা হয়ে যায়। আসলে এই যে অনেক বছর পর এলো এই কারণে সমস্যা হয়। আসলে ১৫ বছর বয়সের পর থেকেই চেকআপে আসা উচিত। তাহলে এই ধরনের সমস্যা আর হবে না।
এছাড়াও ডাঃ আফরিন দাঁতে ক্ষয় রোধে ঘরোয়া উপায় বিষয়েও পরামর্শ দিয়েছেন।
ডাঃ আফরিন বলেন, ঝকঝকে সাদা-মজবুত দাঁত, সুন্দর হাসি সব সময়ই চাই। কিন্তু অনেক সময় নিজেদের অবহেলায় দাঁতে ক্ষয় হতে পারে।
দাঁতের ক্ষয় রোধে ঘরোয়া কিছু উপায়:
১. দিনে দু-বার ব্রাশ করুন ব্রাশের পর ভালো করে মুখ ধুয়ে নিন
২. মিষ্টি খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
৩. খাদ্যতালিকা থেকে প্রক্রিয়াজাত খাবার বাদ দিন
৪. মুখের লালা দাঁত পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে
৫. লিভারের সমস্যা থেকে দাঁত ক্ষয় হতে পারে, লিভারে সমস্যা হলে চিকিৎসা নিতে হবে।
৬. অতিরিক্ত মশলাদার খাবারও এড়িয়ে যেতে হবে। এই ধরনের খাবার থেকে বেশি অ্যাসিডিটি হয়। এই অ্যাসিড দাঁত ক্ষয়ের অন্যতম কারণ।
৭. ফ্লোরাইড সমৃদ্ধ মাউথওয়াশ দিয়ে দাঁত ব্রাশ করুন। এতে দাঁতের ফাঁকে জীবাণু কম জন্ম নেবে। ব্রাশ করার পরেই ফ্লোশিং করুন।
৮. পুষ্টিকর খাবার খাবার খেতে হবে।
দাঁতের যেকোনো ধরনের সমস্যায় অবহেলা না করে চিকিৎসকের (ডেন্টিস্ট) পরামর্শ নিন।
ডিএএম/এমএইচ//
Leave a Reply