নিজস্ব প্রতিবেদক:
৩ জুন বেলা ৩ টায় ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের তৃতীয় বাজেট এটি। আর বাংলাদেশের ৫১তম বাজেট।
সরকারের অতীতের অর্জন এবং উদ্ভূত বর্তমান পরিস্থিতির সমন্বয়ে এবারের বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রে তিনটি খাতকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। এরপর রয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক নিরাপত্তা। পাশাপাশি অগ্রাধিকার থাকছে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ ও বীজে প্রণোদনা, কৃষি পুনর্বাসন ও সারে ভর্তুকি প্রদান, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে। সেই সঙ্গে শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নসহ সার্বিক মানবসম্পদ উন্নয়ন, পল্লী উন্নয়ন ও কর্মসৃজন, গৃহহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহনির্মাণ এবং নিম্নআয়ের মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার থাকছে।
তবে করোনাকালের এই বাজেটকে সামনে রেখে দেশজুড়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো করোনায় গরিব হয়ে যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য বাজেটে কি থাকছে?
সাংবিধানিক বাধ্য-বাধকতার কারণে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কঠোর সতর্কতা মেনে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছে। গতকাল স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হওয়া অধিবেশন শোক প্রস্তাব গ্রহণ শেষে মুলতবি করা হয়েছে। ৩ জুন আবার বিকাল ৩টার অধিবেশনে ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেট প্রস্তাব উত্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানায়, এবার বাজেটকে সামাজিক অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো, সাধারণ সেবা এবং সুদ-ভর্তুকি-ঋণ প্রদানের আওতায় মোট চারটি বৃহত্তর খাতে বিভক্ত করে অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হবে। করোনার বছরেও ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ হতে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির হার ৫.৩ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য থাকছে।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, নতুন বাজেট হবে করোনা মোকাবিলা করে এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ প্রত্যয়ের বাজেট। আগামী বাজেট হবে সাধারণ মানুষের বাজেট। দেশের মানুষ বাঁচানোর ও ব্যবসায়ী বাঁচানোর বাজেট। তবে সামনের দিনগুলোয় আমাদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হতে পারে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা অব্যাহত এবং প্রধান রপ্তানি বাজারগুলোতে মন্দা অব্যাহত থাকলে। আরেক বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রধান শ্রমবাজারগুলোতে শ্রমিক পাঠানো ব্যাহত হলে।
আগের বেশ কয়েক বছরের মতো এবছরও অর্থনীতির প্রয়োজনেই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য মোট রাজস্ব ও বৈদেশিক অনুদান মিলিয়ে আয়ের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। কর বাবদ পাওয়া যাবে ৩ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে এনবিআর নিয়ন্ত্রিত কর ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং এনবিআর বহির্ভূত কর ১৬ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া পাওয়া যাবে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক সহায়তা বাবদ পাওয়া যাবে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।
এবারের বাজেটের অনুদানসহ ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৬.১ শতাংশ। অনুদান ছাড়া বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা (জিডিপির ৬.২ শতাংশ)।
জানা গেছে, নতুন বাজেটে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় টিকাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ১০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল থাকছে। চলতি বাজেটের চেয়ে যা প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি।
এ বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি খাতে বরাদ্দ থাকছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। নিম্নআয়ের মানুষ জীবিকা নিয়ে চরম ভোগান্তিতে আছে। এসব বিবেচনায় রেখে এবার সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আকার ও বরাদ্দ দুটোই গুরুত্ব পাচ্ছে।
দেশে প্রয়োজন হতে পারে চাল আমদানির। এ কারণে সরকার এ বছর খাদ্যেকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ৩০০ কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ পাচ্ছে খাদ্য খাত। সবমিলিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পাচ্ছে সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা।
মহামারি করোনার কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় কমেছে। অনেকে কাজ হারিয়েছেন। অন্যদিকে চাল, আটা, তেল, চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। এতে দরিদ্র ও দুস্থ জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন হয়ে উঠেছে আগের চেয়ে কষ্টের। এ পরিস্থিতিতে গরিব মানুষের জীবনযাপন সহজ করতে দেশের অর্থনীতিবিদরা খাদ্য ও নগদ সহায়তা বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন।
আগামী বাজেটে দরিদ্র মানুষের প্রতি নজর কিছুটা বাড়বে। বাড়ানো হবে মোট উপকারভোগীর সংখ্যাও। তবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বেশির ভাগ ভাতার পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকছে।
এবারের বাজেটে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব করা হচ্ছে। চলতি বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৯ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা।
মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা আট হাজার টাকা বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করা হচ্ছে। এজন্য অতিরিক্ত তিন হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি নির্মাণেও বাজেটে বরাদ্দ রাখা হবে। বর্তমানে সারা দেশে এক লাখ ৮৬ হাজার ৪০৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন।
বয়স্ক ভাতা বাবদ আগামী অর্থবছরে তিন হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৫০৪ কোটি টাকা বেশি।
অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ২২ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪৮ কোটি টাকা করা হচ্ছে।
তৃণমূল পর্যায়ে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশের জন্য ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে, যা চলতি অর্থবছরে রয়েছে মাত্র সোয়া দুই কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আলোচনা শেষে আগামী ৩০শে জুন বাজেট পাস হবে। করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতার কারণে অধিবেশনের আগে কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক হয়নি। কঠোর সতর্কতায় শুরু হওয়া এই অধিবেশনে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ স্বল্প সংখ্যক সংসদ সদস্য অংশ নেন। সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদসহ সিনিয়র সংসদ সদস্যরা অনুপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত সংসদ সদস্যরা গত দিনের আসন বণ্টন এড়িয়ে করোনা সতর্কতা মেনে আসন গ্রহণ করেন।
অধিবেশন কক্ষে এক থেকে দু’টি আসন পর পর তারা বসেছিলেন। অধিকাংশের মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস ও মাথায় ক্যাপ ছিল। সংসদ পরিচালনায় দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও একই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
সংসদ ভবনের প্রবেশমুখে সকলকেই জীবাণুনাশক স্প্রে করা হয়। এমপিসহ সংশ্লিষ্টদের তাপমাত্রা মাপা হয়।
এমএম//
Leave a Reply