সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি: সুনামগঞ্জে সংখ্যালঘু গ্রামে হামলার হোতা যুবলীগ নেতা স্বাধীন মেম্বারকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
স্বাধীন মেম্বারের বাড়ি দিরাই থানার নাচনী গ্রামে। সে স্থানীয় ইউপি সদস্য ও ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি। দিরাইয়ের নাচনী গ্রামের পাশের গ্রাম হচ্ছে শাল্লার নোয়াগাঁও। দুটি উপজেলার দুটি গ্রাম। গত ১৭ মার্চ নাচনী গ্রামের মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে জনতা জড়ো করা হয়। এরপর হাজারো মানুষ হাতে লাঠিসোটা নিয়ে নোয়াগ্রামে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালায়। হামলার সময় অন্তত ৮৭টি বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।
ঘটনার পর দিরাইয়ের নাচনী গ্রামেই ছিলেন শহিদুল ইসলাম ওরফে স্বাধীন মেম্বার। বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। প্রথমে প্রশাসনসহ সুনামগঞ্জের আওয়ামী লীগের নেতাদের ঘটনা সম্পর্কে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। এতে সফলও হয়েছিলেন। তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে বিষয়টি উড়িয়ে দেয়ারও চেষ্টা চালান। ঘটনার দিন রাত থেকেই পুলিশ অ্যাকশন শুরু করে। এ কারণে সকালেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যান দিরাইয়ের নাচনী গ্রামের আলোচিত স্বাধীন মেম্বার। প্রথমে সিলেট শহরে আসেন। এরপর সেখান থেকে পাড়ি জমান কুলাউড়ায়।
থানায় দায়ের করা মামলার সূত্র ধরে জানা যায়, আলোচিত এ ঘটনার নেপথ্যে ছিল শহিদুল ইসলাম ওরফে স্বাধীন মেম্বার। সে সব সময় এলাকায় দাপট দেখায়। ঘটনার দিন স্বাধীন মেম্বার ছিল জনতার মিছিলে অগ্রভাগে। হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হককে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কটূক্তি করেছিলেন নোয়াগাঁওয়ের সংখ্যালঘু পরিবারের এক যুবক। এ ঘটনায় এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। পরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি প্রশমন করতে পুলিশ ওই যুবককে গ্রেফতার করা ছাড়াও মামলা দায়ের করে। যুবককে গ্রেফতার করা হলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।
ঘটনার জের ধরে স্থানীয় জনতা জড়ো হয়ে শাল্লার নোয়াগাঁও গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ ওঠে। ঘটনার মূল হোতা স্বাধীন মেম্বার বলে এরই মধ্যে তদন্তে জানতে পারে প্রশাসন। পুলিশের কাছে দায়ের করা চেয়ারম্যানের মামলায়ও প্রধান আসামি করা হয় স্বাধীন মেম্বারকে।
এদিকে-স্বাধীন মেম্বার পালিয়ে যায় কুলাউড়ার ঘোড়াভুই গ্রামে। সেখানে থাকার সময় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণের জন্য ব্যকুল হয়ে উঠে। সে ফোন নম্বর সংগ্রহ করে এ ব্যাপারে সহযোগিতা চায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের কয়েকজন সাংবাদিকের কাছে। রাতে সে সিলেটসহ বিভিন্ন থানার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগও করে। রাত ১০টার দিকে সিলেটের পিবিআইয়ের এক কর্মকর্তার সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। এ সময় সে নিজের পরিচয় দিয়ে আত্মসমর্পণ করবে বলে জানায়।
এই মেসেজের পরিপ্রেক্ষিতে পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা রাত ৩টার দিকে কুলাউড়া থেকে তাকে আটক করেন।
বৃহস্পতিবার সকালে আলোচিত স্বাধীন মেম্বারকে নিয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন সিলেট পিবিআইয়ের এসপি মো. খালেদুজ্জামান। এ সময় সাংবাদিকদের জানান, শাল্লা থানার ৭ নম্বর মামলার প্রধান আসামি শহিদুল ইসলাম ওরফে স্বাধীন মেম্বার। স্বাধীন মেম্বারের নেতৃত্বে ১৪শ থেকে ১৫শ মানুষ ওই এলাকায় আক্রমণ করেন। এরপর থেকে সে পলাতক ছিল। রাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া এলাকায় স্বাধীন মেম্বারের অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে। তিনি জানান, যেহেতু স্বাধীন মেম্বার সুনামগঞ্জের মামলার আসামি এ কারণে তাকে সুনামগঞ্জ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ পুলিশ জানায়, স্বাধীন মেম্বার যেহেতু প্রধান আসামি তার কাছ থেকে আলোচিত এ ঘটনার তথ্য পাওয়া যাবে। প্রয়োজনে তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানায় পুলিশ। এদিকে- পুলিশের হাতে গ্রেফতারের আগে আলোচিত এ ঘটনা সম্পর্কে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় জানায়-ঘটনা সম্পর্কে তিনি অবগত নন। কিন্তু ঘটনা ঘটার পরপরই তিনি প্রথমে পুলিশকে অবগত করেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদেরও অবগত করেন। এর বেশি কিছু তিনি জানেন না।
শাল্লার স্থানীয় হবিবপুর ইউপি চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল তার মামলার এজাহারে স্বাধীন মেম্বারকেই প্রধান আসামি করেছেন। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেছেন, ঘটনার মূল হোতা স্বাধীন মেম্বার। তার নেতৃত্বে নাচনীসহ আশেপাশের মানুষজন দলবেঁধে হামলা চালিয়েছিল। তাদের হামলার পর থেকে নোয়াগাঁও গ্রামের সংখ্যালঘুরা আতঙ্কে রয়েছে।
গতকাল ভোরে স্বাধীন মেম্বার গ্রেফতার হওয়ার পর মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে বলেও জানান। এদিকে শাল্লার নোয়াগাঁওয়ে হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ২২ জনকে গত শুক্রবার কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রাতে স্বাধীন মেম্বারসহ গ্রেফতার হন ৮ জন।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘটনাস্থল পরিদর্শন: হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত নোয়াগাঁও গ্রাম পরিদর্শন করেছেন আওয়ামী লীগ বিএনপি নেতৃবৃন্দ। গ্রাম পরিদর্শন শেষে তারা ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। গতকাল দুপুরে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরীর নেতৃত্বে বিএনপির প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে তারেক রহমানের সহায়তা ফান্ড থেকে ১ লাখ টাকা ও নিপুন রায় চৌধুরীর পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুন রায় চৌধুরী, জেলা বিএনপির সভাপতি কলিম উদ্দিন মিলন, সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নুরুল, মহি উদ্দিন চৌধুরী মাসুক, তাহির রায়হান চৌধুরী।
সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুটও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা সহায়তা প্রদান করেন ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে। এ সময় জেলা আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আজাদুল ইসলাম রতন, দিরাই পৌরসভার সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা মোশাররফ মিয়া, রঞ্জন রায় উপস্থিত ছিলেন।
যুবলীগের প্রেস ব্রিফিং: শাল্লার হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে হামলার ঘটনায় সংবাদ সম্মেলন করেছে জেলা যুবলীগ। গতকাল দুপুর ১টায় রমিজ বিপণিস্থ দলীয় কার্যালয়ে ওই সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত। সাংবাদিক সম্মেলনে ঘটনার প্রধান আসামি শহিদুল ইসলাম স্বাধীন যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বলে জানানো হয়। জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক খায়রুল হুদা জানান, স্বাধীনের বয়স ৬১ বছর। এই বয়সের কেউ যুবলীগের রাজনীতি করতে পারে না। কিছু মিডিয়া স্বাধীনকে যুবলীগ নেতা হিসেবে খবর ছাপা হয়েছে, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
হেফাজতে ইসলামের সংবাদ সম্মেলন: গত ১৭ মার্চ সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনার নিন্দা, ক্ষতিগ্রস্তদের সমবেদনা ও হামলায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম দিরাই উপজেলা শাখা।
পাশাপাশি নোয়াগাঁও গ্রামের হিন্দু যুবক ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার ঘটনা ঘটিয়ে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্টের অভিযোগ তুলে তার দেশবিদেশে ষড়যন্ত্র তদন্তের মাধ্যমে উন্মোচন ও শাস্তির দাবি জানায় হেফাজত।
গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় দিরাই উপজেলা হেফাজতে ইসলামের উদ্যোগে সংগঠনের অস্থায়ী কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা হেফাজতের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মুখতার হোসেন চৌধুরী লিখিত বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
দিরাই উপজেলা হেফাজতে ইসলামের সভাপতি মাওলানা শায়খ আজিজুর রহমানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, উপজেলা হেফাজতের সহসভাপতি মাওলানা আব্দুল হাই, প্রচার সম্পাদক মাওলানা আবিদুর রহমান, নির্বাহী সদস্য মাওলানা ইলিয়াস আহমদ, মাওলানা মোহাম্মদ মিয়া, হাফেজ মো. ইশা, মাওলানা আজমল হোসেন।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার মহোদয়গণের অনুরোধে ২২ তারিখে হেফাজতে ইসলামের জামালগঞ্জ উপজেলার সমাবেশ স্থগিত করা হয়েছে। তবে আগামী মাসের (এপ্রিল) মাঝামাঝি সমাবেশ করার শর্ত আমরা মেনে নিয়েছি। হেফাজত নেতা হাফিজ মো. কাউসার আহম্মদ এই তথ্য জানান।
ডিএ//
Leave a Reply