হাসান আহমেদ সওদাগর, সানফ্রান্সিসকো, যুক্তরাষ্ট্র: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের শেষ দফা প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ক শেষ হলো।
বৈশ্বিক মহামারি করোনা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত আক্রমণ- সবই ছিল শেষ বিতর্কে।
সিএনএনের জরিপ বলছে, ৫৩ শতাংশই মনে করেন বাইডেন শেষ বিতর্কে জয়ী হয়েছেন। বিতর্কে করোনা মহামারিতে গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কড়া সমালোচনা করেন জো বাইডেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণে করেন ট্রাম্প।
প্রমাণিত হয়নি এমন ব্যবসায়িক স্বার্থ নিয়ে জো বাইডেনকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন ডলান্ড ট্রাম্প। তিনি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হয়ে ওঠার দাবি করেন। নিয়ন্ত্রিত বিতর্কে করোনা মোকাবিলায় তিনি গৃহীত পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন।
ট্রাম্প জানান, এসব পদক্ষেপের ফলে রক্ষা করা গেছে অনেক জীবন। কিন্তু মাইক জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জো বাইডেন তা খণ্ডন করলেন। ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করলেন। বললেন, তিনি করোনাভাইরাসের ঝুঁকিকে ছোট করে দেখেছেন। এর দায়িত্বও নিচ্ছেন না। বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেনের ইউক্রেনে ব্যবসায়িক স্বার্থ নিয়ে দুই নেতা তীব্র বিতর্ক করেন।
রিপাবলিকান দল থেকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও বিরোধী ডেমোক্রেট দল থেকে আগামী ৩রা নভেম্বরের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জো বাইডেন। তাদের মধ্যে নির্বাচনের আগে মুখোমুখি আর কোনো বিতর্ক হবে না। বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলীয় সময় রাত ৯টায় শুরু হয় বিতর্কটি।
প্রথম বিতর্কে তাদের মধ্যে অনভিপ্রেত ঘটনার অবতারণা হওয়ায় এবার নেয়া হয়েছিল ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা। প্রথম বিতর্কে জো বাইডেনের কথার মাঝে বার বার বিঘ্ন সৃষ্টি করেন ট্রাম্প। এজন্য তাকে তীব্র সমালোচনার মূখে পড়তে হয়।
ট্রাম্পের করোনা জনিত কারণে
দ্বিতীয় দফা বিতর্ক বাতিল হয়। নিয়ম পাল্টে তৃতীয় দফা বিতর্ক হলো। এতে একজন প্রার্থী যখন বক্তব্য রাখছিলেন তখন অন্যজনের মাইক বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, যাতে তিনি বক্তব্যের মাঝে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না পারেন। এতে মডারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সাংবাদিক ক্রিশ্চেন ওয়েলকার।
এ বিতর্কে উঠে আসে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ইস্যু। এ ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, তিনি পরিবেশ ভালোবাসেন। প্রত্যাশা করেন পরিষ্কার পানি ও বাতাস। তিনি বলেন, তাদের আছে সবচেয়ে ভালো, সর্বনিম্ন কার্বন নির্গমন। কিন্তু চীন ও রাশিয়াকে এক্ষেত্রে ‘নোংরা’ বলে অভিহিত করেন তিনি। জবাবে বাইডেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করতে নৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে আমাদের। ট্রাম্পকে আরো চার বছর রাখা হলে দূষণ নির্মূল বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সমস্যায় ফেলবে। বাইডেন দাবি করেন, তিনি জলবায়ু বিষয়ক যে পরিকল্পনা নিয়েছেন তাতে লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ ইস্যুতে উত্তপ্ত বিতর্ক হয় দুই নেতার মাঝে।
ট্রাম্প বার বার দাবি করেন, তিনি কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনিদের জন্য আব্রাহাম লিঙ্কনের কিছু ব্যতিক্রম বাদে, একজন শ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন দাসপ্রথার ইতি ঘটিয়েছিলেন। জো বাইডেনের দিকে সমালোচনার তীর ছুড়ে দিয়ে ট্রাম্প বলেন, জো বাইডেন বহু দশক ধরে রাজনীতিতে। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের জন্য তেমন কিছু করেন নি। কংগ্রেসে একবার কৃষ্ণাঙ্গদের ‘সুপার প্রিডেটর’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন বলে এ মন্তব্য সামনে নিয়ে আসেন ট্রাম্প। তবে বাইডেন এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ট্রাম্প বলেছেন, কৃষ্ণাঙ্গদের ঐতিহাসিক কলেজ ও ইউনিভার্সিটিগুলোকে তিনি রক্ষা করেছেন। জবাব দিতে গিয়ে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করেন জো বাইডেন।
যুক্তরাষ্ট্রের টিনেসি রাজ্যের নাশভিলে অনুষ্ঠিত এই বিতর্ক যুক্তরাষ্ট্র সহ সারা বিশ্বের কোটি কোটি দর্শক পর্যবেক্ষণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে দেখা হয় সারা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর হিসেবে। এ প্রেক্ষাপটেই এই বিতর্কের দিকে দৃষ্টি ছিল বিশ্ববাসীর।
যখন করোনায় যুক্তরাষ্ট্রের কমপক্ষে দুই লাখ ২১ হাজার মানুষ মারা গেছেন, তখন এই নির্বাচনে নিজেকে বিজয়ী করার নতুন এক সুযোগ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন ট্রাম্প।
তবে এখনো পুরো যুক্তরাষ্ট্রে জনমত জরিপে এগিয়ে আছেন জো বাইডেন। তবে নির্বাচনের ফল নির্ধারণকারী সুইংস্টেটগুলোতে তাদের ব্যবধান কম। করোনাভাইরাস ইস্যুতে ট্রাম্পকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেন জো বাইডেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে এত মানুষের মৃত্যুর জন্য যে ব্যক্তি দায়ী তার এই দেশের প্রেসিডেন্ট থাকা উচিত নয়। জবাবে ট্রাম্প বলেন, ভয়াবহ মহামারি এখন শেষ হয়ে গেছে। আমরা প্রতিটি বিষয় দেখছি। এই ভাইরাস এখন বিদায়ের পথে। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটি টিকা চলে আসবে বলে তিনি দাবি করেন। তবে বেশির ভাগ প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আগামী বছরের মধ্যভাগ ছাড়া টিকা পর্যাপ্ত আকারে পাওয়া যাবে না।
এদিকে বৃহস্পতিবার সুইংস্টেট বলে পরিচিত ‘ওহাইও’ রাজ্যে একদিনে রেকর্ড সংক্রমণ ঘটেছে। আরো কিছু রাজ্যে সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিতর্ক শুরুর পর পরই প্রতিজন প্রার্থীর বিদেশের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের বিষয়ে একে অন্যকে ঘায়েল করেন। জো বাইডেন ও তার ছেলে হান্টার বাইডেন অনৈতিকভাবে চীন ও ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বলে অভিযোগ করেন ট্রাম্প। তবে এক্ষেত্রে যথাযথ কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি তিনি। ট্রাম্পের এ অভিযোগকে মিথ্যা ও অপমানজনক বলে আখ্যায়িত করেন বাইডেন। তিনি নিজের ও পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। বলেন, বিদেশ থেকে একটি পয়সাও নেননি তারা। বাইডেন দাবি করেন, এসব মিথ্যা বলে ট্রাম্প ভোটারদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন।
এ সময় সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে জো বাইডেন বলেন, তার এসব কাণ্ডজ্ঞানহীন অভিযোগ আনার কারণ আছে। এটা তার পরিবার বা আমার পরিবারের বিষয় নয়। এটা আপনাদের পরিবারকে নিয়ে বলা হচ্ছে, আপনাদের পরিবারকে খারাপভাবে আঘাত করা হচ্ছে। একপর্যায়ে ট্রাম্পের আয়কর ফাঁকি দেয়ার ইস্যু সামনে তুলে আনেন জো বাইডেন। কয়েকদিন আগে নিউইয়র্ক টাইমস যে তদন্ত করেছে তা তুলে ধরেন। নিউইয়র্ক টাইমস রিপোর্টে বলেছে, ট্রাম্পের আয়কর রিটার্নে দেখা যাচ্ছে তিনি কমপক্ষে ২০ বছরের ওপরে কোনো ফেডারেল আয়কর দেননি।
ট্রাম্পের উদ্দেশে জো বাইডেন বলেন, আপনার আয়কর রিটার্ন প্রকাশ করুন, না হয় দুর্নীতি নিয়ে কথা বলা বন্ধ করুন।
এখানে উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রে পূর্ববর্তী সব প্রেসিডেন্ট তাদের আয়কর রিটার্ন প্রকাশ করেছেন। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে চলে আসা এই রীতি ভঙ্গ করেছেন ট্রাম্পই। তিনি আয়কর রিটার্ন প্রকাশ করেননি। বাইডেনের জবাবে বলেছেন, তিনি লাখ লাখ ডলার পরিশোধ করেছেন। ট্রাম্প আরো একবার বলেন, দীর্ঘমেয়াদি একটি অডিট চলছে। এটা শেষ হলেই তিনি আয়কর রিটার্ন প্রকাশ করবেন।
দুই প্রার্থীই স্বাস্থ্যসেবা ও চীন নীতি নিয়েও ঘোরতর বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় ট্রাম্পকে সবচেয়ে বর্ণবাদী প্রেসিডেন্টদের একজন বলে উল্লেখ করেন জো বাইডেন। তিনি বলেন, ট্রাম্প প্রতিটি বর্ণবাদী উত্তেজনায় রশদ যুগিয়েছেন।
বাইডেনকে জয়ী বলছে সিএনএন: বিতর্কের পরই চালু করা সিএনএনের অনলাইন পোলে এগিয়ে রয়েছেন জো বাইডেন। ভোট দেয়া ৫৩ শতাংশই মনে করেন বিতর্কে বাইডেন ট্রাম্পের থেকে ভালো করেছেন। অপরদিকে ট্রাম্পের পক্ষে ভোট পড়েছে ৩৯ শতাংশ। এ ছাড়া, ট্রাম্পের যেসব সমালোচনা বাইডেন করেছেন তা যুক্তিযুক্ত ছিল কিনা এমন প্রশ্নের পক্ষে ভোট পড়েছে ৭৩ শতাংশ। ২৬ শতাংশ বলছে এগুলো অযৌক্তিক ছিল। আবার বাইডেনের বিরুদ্ধে আনা ট্রাম্পের অভিযোগকে সত্যি মনে করেন ৫০ শতাংশ মানুষ। ৪৯ শতাংশ মনে করেন এসব অভিযোগ অযৌক্তিক।
এবার রেকর্ড সংখ্যক মার্কিনী আগাম ভোট প্রদান করেছেন। বাংলাদেশী বাংশোদ্ভূত অনেক মার্কিন নাগরিক এখনো নির্বাচনের নিরপেক্ষ ফলাফল নিয়ে সংসয় প্রকাশ করেছেন। তারা ডেমোক্রেট প্রার্থীকে জরিপে বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে এখন এগিয়ে রেখেছেন। তবে ট্রাম্পের পক্ষে ‘কায়দা করে’ শেষ পর্যন্ত ফল নেয়ারও একটা সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না !
এসএস//
Leave a Reply